গাজীপুরে গ্যাসের তীব্র সংকট
সরবরাহ কমে যাওয়ায় গাজীপুরে শিল্পকারখানা ও বাসাবাড়িতে তীব্র গ্যাস–সংকট দেখা দিয়েছে। কোথাও জ্বলছে না রান্নার চুলা, আবার কোথাও আগুন থাকলেও তা মিটমিট করছে। এ কারণে রান্না ও খাবার নিয়ে ভোগান্তিতে পড়েছেন গাজীপুর মহানগর ও কালিয়াকৈর উপজেলার বিভিন্ন এলাকার বাসিন্দারা। এ ছাড়া কারখানাগুলোতেও গ্যাসের চাপ কম থাকায় উৎপাদন কমেছে।
আজ মঙ্গলবার সকাল থেকে দুপুর পর্যন্ত মহানগরীর ভোগড়া, বাসন সড়ক, কড্ডা, কোনাবাড়িসহ অন্তত ১০টি এলাকায় গ্যাসের সংকট বলে জানা গেছে। এসব এলাকার বাসিন্দারা জানান, সকাল ১০টার পরপরই গ্যাস সরবরাহ প্রায় বন্ধ হয়ে যায়। কোথাও একেবারে বন্ধ ছিল, কোথাও মিটমিট আগুন জ্বলছিল।
মহানগরীর ভোগড়া এলাকায় কয়েক মাস ধরে গ্যাসের চুলায় ঠিকমতো গ্যাস পাচ্ছি না। যে পরিমাণে জ্বলে, তাতে রান্নার কাজ হয় না। তাই বাধ্য হয়ে বাজার থেকে সিলিন্ডার গ্যাস কিনে নিয়েছি। সেটি দিয়েই এখন বাসার রান্নার কাজ করছে।
গাজীপুরের কোনাবাড়ি, কালিয়াকৈর, কাশিমপুর ও এর আশপাশের এলাকার বেশির ভাগ কারখানায় গ্যাস–সংকটের কারণে উৎপাদন ব্যাহত হচ্ছে। পাশাপাশি গ্যাস–সংকটে দুর্ভোগে পড়েছেন বাসাবাড়ির গ্রাহকেরা। গাজীপুর শহরের পাশেই মারিয়ালী এলাকা। এলাকার বাসিন্দা রফিকুল ইসলাম বলেন, ‘বেশি ভাড়া দিয়ে গ্যাস–সংযোগ থাকা একটি ফ্ল্যাট ভাড়া নিয়েছিলাম। কিন্তু বাসায় সারা দিনে গ্যাসই পাওয়া যায় না। রাতে এবং সপ্তাহের ছুটির দিনে কিছু গ্যাস পাওয়া যায়।’
গ্যাস-সংকটের বিষয়ে জানতে চাইলে গাজীপুর তিতাসের উপমহাব্যবস্থাপক সুরুজ আলম বলেন, গাজীপুরে প্রতিদিন যে পরিমাণ গ্যাসের চাহিদা আছে, সে পরিমাণ সরবরাহ নেই। সরবরাহ কম থাকায় বাসাবাড়ি ও শিল্পকারখানায় গ্যাস–সংকট দেখা দিয়েছে।
গাজীপুরে একাধিক কারখানা কর্তৃপক্ষ জানায়, কয়েক মাস ধরে বিভিন্ন এলাকার শিল্পকারখানায় তীব্র গ্যাস–সংকট দেখা দিয়েছে। গ্যাসের চাপ কমে যাওয়ায় অর্ধেকে নেমে এসেছে পণ্য উৎপাদন। শিল্পমালিকদের অভিযোগ, প্রতি ঘনফুটে ১৫ পিএসআই গ্যাসের চাপ থাকার কথা থাকলেও অনেক কারখানায় সেটি নেমে আসে মাত্র দুই-তিনে। আবার কোনো কোনো কারখানায় নেমে এসেছে শূন্যে। গ্যাসের পর্যাপ্ত চাপ না থাকায় চাহিদামতো উৎপাদন করতে না পারায় আর্থিক লোকসানে পড়ার আশঙ্কা আছে। এ কারণে ডিজেলচালিত জেনারেটর ব্যবহার করে উৎপাদন কার্যক্রম চালাতে হচ্ছে। এতে উৎপাদন খরচ বেড়ে যাচ্ছে।
কোনাবাড়ি এলাকার একটি কারখানার মহাব্যবস্থাপক হাবিবুর রহমান জানান, তাঁদের কারখানায় অনেক দিন ধরেই গ্যাসের সংকট। কয়েকবার অভিযোগ করেও কোনো লাভ হয়নি। গ্যাসের অভাবে কারখানার উৎপাদন ৫০ শতাংশ কমে গেছে।
গাজীপুরের সদর, কোনাবাড়ি ও কালিয়াকৈর উপজেলার বিভিন্ন এলাকায় নানা ধরনের শিল্পপ্রতিষ্ঠান গড়ে উঠেছে। এগুলোতে উৎপাদনের অন্যতম উপাদান হচ্ছে প্রাকৃতিক জ্বালানি। অর্থাৎ গ্যাসের ওপর ভিত্তি করেই এসব শিল্পপ্রতিষ্ঠান গড়ে উঠেছে। চলমান গ্যাস–সংকটে তৈরি পোশাকশিল্পের প্রতিষ্ঠানগুলো বিদেশি কার্যাদেশ সময়মতো সরবরাহ করতে পারবে কি না, তা নিয়ে শঙ্কা আছে। এই সংকট চলতে থাকলে এসব এলাকার অনেক শিল্পকারখানা একেবারেই বন্ধ হয়ে যাবে বলে অনেকে জানিয়েছেন।
গাজীপুরের চান্দনা চৌরাস্তা এলাকার একটি কারখানার পরিচালক আবিদুর রহমান বলেন, এক সপ্তাহ ধরে তীব্র গ্যাস–সংকটের কারণে তাঁদের কারখানায় উৎপাদন ব্যাহত হচ্ছে। ফলে প্রচুর লোকসানের সম্মুখীন হতে হবে। বিদেশি ক্রয়াদেশের পণ্য সময়মতো দিতে না পারলে আরও সংকট দেখা দেবে। তখন শ্রমিকদের বেতন সময়মতো পরিশোধ করা সম্ভব হবে না।
গাজীপুর তিতাসের ব্যবস্থাপক (ট্রান্সমিশন ও ডিস্ট্রিবিউশন) মো. রেদোয়ান বলেন, ‘জেলায় বর্তমানে যে চাহিদা আছে, সে পরিমাণে গ্যাস সরবরাহ করতে পারছি না। এতে শিল্পকারখানা ও বাসাবাড়িতে গ্যাসের সরবরাহ বা চাপ দুটিই কমে গেছে। ১৫ অক্টোবরের পর নতুন এলএসজি দেশে পৌঁছাবে। তখন হয়তো সরবরাহ বাড়ানো সম্ভব হবে।’
তিন মাস গ্যাস নেই চন্দ্রা এলাকায়
এদিকে তিন মাস ধরে কালিয়াকৈর উপজেলার চন্দ্রা জোনাল অফিসের আওতায় উপজেলার বিভিন্ন এলাকায় আবাসিক গ্রাহকেরা গ্যাস পাচ্ছেন না। গ্যাস না পেয়ে চরম দুর্ভোগে পড়েছেন উপজেলার কালিয়াকৈর, লতিফপুর, পিরেরটেকি, জানেরচালা, টানকালিয়াকৈরসহ বিভিন্ন এলাকার বাড়ির মালিক ও ভাড়াটেরা। বাধ্য হয়ে বাজার থেকে গ্যাস সিলিন্ডার, চুলা, কাঠ কিনে ও অন্যান্য জ্বালানি ব্যবহার করে রান্নাবান্নার কাজ করছেন তাঁরা।
এই গ্রাহকদের অভিযোগ, গ্যাস না পেলেও নিয়মিত গ্যাসের বিল দিতে হচ্ছে। এ ঘটনায় উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা ও চন্দ্রা জোনাল অফিসে বারবার অভিযোগ দিয়েও সমস্যার সমাধান হচ্ছে না। এ কারণে গতকাল সোমবার দুপুরে ওই সব এলাকার মানুষ চন্দ্রা জোনাল গ্যাস অফিস ঘেরাও করেন। এ সময় বিক্ষুব্ধ লোকজন ওই অফিসের কর্মকর্তা-কর্মচারীদের অবরুদ্ধ করে বিক্ষোভ করেন। খবর পেয়ে কালিয়াকৈর থানার পুলিশ ঘটনাস্থলে গিয়ে পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণে আনে।
তিতাস গ্যাস ট্রান্সমিশন অ্যান্ড ডিস্ট্রিবিউশন কোম্পানির নবীনগর-চন্দ্রা জোনাল মার্কেটিং অফিসের ব্যবস্থাপক খোরশেদ আলম বলেন, ‘এটা একটা জাতীয় সমস্যা। আমাদের সিস্টেমে গ্যাস কমে গেছে। যত দিন পর্যন্ত জাতীয়ভাবে গ্যাসের সমস্যা সমাধান না হবে, তত দিন পর্যন্ত এই সমস্যা আমাদের পক্ষে সমাধান করা সম্ভব নয়।’